নানান রঙের করবী

মোকারম হোসেন
২২ নভেম্বর ২০২৫, ০২:২১ পূর্বাহ্ণ
নানান রঙের করবী

আপনি নিশ্চয় করবী ফুলের নাম জানেন। আরও বেশি জানেন রক্তকরবীর নাম। রক্তকরবী নামে একটি নাটকের কথাও আমরা জানি। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম আত্মজা ও একটি করবী গাছ। একটি ফুল কতটা জনপ্রিয় হলে মানুষের এমন জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু যে ফুলটি আমাদের এত চেনাজানা, এতটাই প্রিয়; তার খোঁজখবর কি আমরা খুব একটা রাখি? আপনি কি ইদানীং আপনার আশপাশে কোনো করবীগাছ দেখেছেন? আমাদের মনন ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া সেই আবেগ জড়ানো রক্তকরবী? তার পরিবর্তে আপনি হয়তো দেখেছেন সাদাকরবী কিংবা পদ্মকরবী। তা–ও আমাদের রীতিবদ্ধ কোনো বাগানে।

তিন বা চার দশক আগের তুমুল জনপ্রিয় এই ফুল আমাদের ঘরের আঙিনা থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে। এখন আর কেউ শখ করে নিজের বাগানে রক্তকরবী রোপণ করেন না। ইদানীং কোনো কোনো বাগানে চোখে পড়ে পদ্মকরবী। তা–ও সংখ্যায় খুবই কম। দেশের নতুন সড়কগুলোতে রোপণ করা হচ্ছে করবীর গাঢ় লাল রঙের আরেকটি নতুন রকমফের। সাদা রঙের করবী ফুলও কদাচ কোনো কোনো বাগানে দেখা যায়। সবুজের পটভূমিতে দু–এক স্তবক তুষারশুভ্র করবী চারপাশের দৃশ্যপট বদলে দেয়। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বাগানে দুধে আলতা বা ধূসর গোলাপি রঙের করবী দেখে বেশ চমৎকৃত হয়েছি। আমাদের দেশে করবীর এই রকমফের চোখে পড়েনি।

করবীর সমাদর বা জনপ্রিয়তা কতটা, তা বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশই যথেষ্ট। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ অন্তত ১১টি পঙ্‌ক্তিতে করবীর কথা বলেছেন। ‘শরতে ধরাতলে শিশিরে ঝলমল,/ করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি।’ এটা করবীর সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। আবার ব্যবহারিক গুণের কথাও বলেছেন তিনি, ‘ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী।’ সাদা রঙের করবীর কথাও ভোলেননি কবি। তিনি লিখেছেন, ‘ভোর বেলাকার চাঁদের আলো/ মিলিয়ে আসে শ্বেত করবীর রঙে।’

জীবনানন্দ দাশ অসাধারণ ব্যঞ্জনায় করবীর সৌন্দর্য তুলে এনেছেন, ‘শাদা স্তন ঝরে/ করবীর: কোন্ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল,/ তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে: নরম ব্যাকুল।’ অন্যত্র আছেÑ‘...চোখে ক্লান্তি নাই/ কাঠমল্লিকায়/ কাঁঠালী শাখায়/ করবীর বনে/ হিজলের সনে...’। তবে উদ্ভিদবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, জীবনানন্দ দাশ এই করবী বলতে কলকে ফুলকে বুঝিয়েছেন। একসময় অনেকেই না জেনে কলকে আর করবীর মধ্যে তালগোল পাকিয়েছেন।

করবী (Nerium oleander) প্রাচীন ফুল। লোককাহিনিতেও তার প্রমাণ মেলে। আদি আবাস এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। গাছ চিরসবুজ, দুই থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গোড়া থেকে অনেকগুলো ডাল গজিয়ে গাছ বেশ ঝোপাল হয়ে ওঠে। পাতা সুন্দর, ডালের আগার দিকে বেশি, থাকে বিপ্রতীপ বিন্যাসে, ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা, ডাবল জাতের করবীর পাতা আরেকটু বড় ও পুরু। ডালের আগায় গুচ্ছবদ্ধভাবে ফোটা এই ফুলের প্রধান মৌসুম গ্রীষ্ম-বর্ষা, কখনো কখনো শরৎ-হেমন্তেও কিছু ফুল দেখা যায়। আমাদের দেশে সাধারণত তিন রকম করবী দেখা যায়—রক্তকরবী, সাদাকরবী (শ্বেতকরবী) ও ডাবল গোলাপি বা পদ্মকরবী। প্রায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার চওড়া ফুলগুলো, হালকা সুগন্ধি। গোলাপি রঙের সিঙ্গেল ভ্যারাইটিও আছে। ফল সজোড়, সরু, লম্বা ও খাড়া। সাধারণত কলমে চাষ। গাছ ঘন ঘন ছাঁটা নিষ্প্রয়োজন। এ গাছের মূল, পাতা, বীজ—সবই বিষাক্ত। এ জন্য সতর্কতা প্রয়োজন।

Read more — প্রকৃতি ও পরিবেশ
← Home