বিটকয়েনের গল্প: ভয় নয়, প্রস্তুতি দরকার

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:১৩ অপরাহ্ণ
বিটকয়েনের গল্প: ভয় নয়, প্রস্তুতি দরকার

এক সময় রঙিন খেলনার দোকানে ছোট ছোট ড্রোন বিক্রি হতো। বাচ্চারা কিনতো খেলতে, বড়রা তাকাতো হাসিমুখে। তখন কেউ কল্পনাও করেনি, এই খেলনাগুলো একদিন পার্সেল পৌঁছে দেবে, ট্রাফিক নজরদারি করবে বা দুর্যোগের সময় ত্রাণ নিয়ে যাবে দুর্গম গ্রামে। যা ছিল নিছক কৌতূহল, ধীরে ধীরে তাই হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবনের বড় অবকাঠামো।

আসলে বিটকয়েনকেও আমরা সেই দৃষ্টিতেই দেখতে পারি। অনেকেই একে এখনও “ইন্টারনেটের টাকা” বা “ডিজিটাল সোনা” বলে খাটো করে দেখেন। অথচ বাস্তবে এটি এক নতুন ধরনের আর্থিক প্রযুক্তি। কোনও রাষ্ট্র, ব্যাংক বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে নয় বরং সবার চোখের সামনে খোলা খাতায় চলে এই ব্যবস্থা। এই খাতাটার নাম ব্লকচেইন। ভাবতে পারেন যেন এক বিশাল নোটবই, যেটা সারা পৃথিবীর হাজার হাজার কম্পিউটারে একসঙ্গে রাখা আছে। সেখানে একবার লেখা কিছু গোপনে পাল্টানো যায় না, কারণ আগের পাতা না বদলালে পরের পাতাও বদলানো যাবে না। ফলে কেউ ইচ্ছেমতো টাকা বানাতে বা হিসাব চুরি করতে পারে না। এখানেই ক্রিপ্টোকারেন্সির বিস্ময়। কারণ এখানে কারও ওপর ভরসা নয়। ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ায় খাঁটি নিয়ম আর প্রযুক্তি।

 

সম্ভাবনার দরজা

এই প্রেক্ষাপটে মোটাদাগে বলতে গেলে, প্রযুক্তিটি এখনও শুরুর পথে থাকলেও সম্ভাবনা বিশাল। আমরা দেখতে পাই যে এর মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে কয়েক মিনিটেই টাকা পাঠানো যায়, খরচও তুলনায় কম, ব্যাংক বন্ধ থাকলেও লেনদেন থামে না, আর শুধু একটি স্মার্টফোন থাকলেই যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেসব তরুণ ফ্রিল্যান্সার বা ছোট রফতানিকারক আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পেমেন্ট আনতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়েন তাদের জন্য এটা সত্যিই কার্যকর বিকল্প হতে পারে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের খোলা আর্থিক অবকাঠামো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। এর বাইরেও এই প্রযুক্তিকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য নতুন ধারণা: স্মার্ট কনট্রাক্ট, টোকেনাইজড সম্পদ, বিকেন্দ্রীভূত আর্থিক সেবা (ডিফাই)— যেগুলো ভবিষ্যতের আর্থিক ব্যবস্থার ধরনই পাল্টে দিতে পারে।

 

ঝুঁকির বাস্তবতা

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি ঝুঁকিও কম নয়, বরং তা বেশ বড় এবং বাস্তব। সাধারণভাবে মুদ্রা মানেই স্থিরতা, স্থিতিশীল দাম এবং নির্ভরযোগ্যতা। অথচ ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে আমরা দেখি ঠিক উল্টো ছবি। এর দাম কখনও হঠাৎ আকাশছোঁয়া হয় আবার কখনও একেবারে তলানিতে নেমে যায়। অনেক মানুষ রাতারাতি লাখপতি হন, আবার কারও সঞ্চয় মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। এই ওঠানামা এত দ্রুত ঘটে যে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পক্ষে তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এর পেছনে কোনও রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি নেই, নেই কোনও ব্যাংকের তদারকি বা কোম্পানির নিয়মিত মুনাফা— মূল্য নির্ভর করে কেবল মানুষের চাহিদা, বিশ্বাস আর বাজারের মনস্তত্ত্বের ওপর। এই শূন্যতার সুযোগেই ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের প্রতারণা। আমরা দেখতে পাই, নানা স্ক্যাম, হ্যাকিং, ফিশিং, এক্সচেঞ্জ হ্যাক বা ভুয়া কয়েন ইস্যু করার মতো প্রতারণা নিয়মিত ঘটছে। ডিজিটাল দুনিয়ার পুরনো সব ফাঁদ যেন এখানে এসে নতুন রূপে হাজির হয়েছে।

তার ওপর আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এখনও সব দেশ বিটকয়েন বা অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এক দেশে যেটা বৈধ, অন্য দেশে সেটাই অবৈধ হতে পারে। ফলে বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা, মানি লন্ডারিং রোধ, কর আদায়, লেনদেনের স্বচ্ছতা—সব দিকেই ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

মোদ্দা কথা এই যে এ প্রযুক্তি যেমন একদিকে নতুন সুযোগ তৈরি করছে ঠিক, তেমনই অন্যদিকে বড় ধরনের ঝুঁকিও বয়ে আনছে। তাই এই খাতে প্রবেশের আগে চোখ বুজে ঝাঁপ না দিয়ে, তার ঝুঁকি বোঝা এবং সঠিক নিয়ম-কানুন গড়ে তোলাই হওয়া উচিত সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।

বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ ব্যাংক এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই শুরু থেকেই সতর্ক থেকেছে। তারা বহুবার জানিয়েছে, ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন এখনও বৈধ নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এতে সহায়তা করতে পারবে না।  কারণও স্পষ্ট— মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাস অর্থায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ এবং বিনিয়োগকারী সুরক্ষার অভাব। আমাদের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে এসব ঝুঁকি উপেক্ষা করা কঠিন। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রযুক্তি-সচেতন এক অংশ ভিপিএন বা পিয়ার-টু-পিয়ার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্রিপ্টো লেনদেনে ঢুকে পড়ছে। সেখানে ক্ষতির দায় একেবারেই ব্যক্তিগত, আর প্রতিকারের পথও প্রায় নেই। এই পরিস্থিতিতে জরুরি হয়ে পড়েছে একদিকে ঝুঁকি সামলে অন্যদিকে উদ্ভাবনের সুযোগ রেখে মাঝামাঝি এক ভারসাম্য তৈরি করা।

 

এগোতে হবে ধাপে ধাপে

এই ভারসাম্য গড়তে হলে আমাদের এক লাফে নয়, ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। কারণ একদিকে যেমন এতে বিশাল সম্ভাবনা আছে, অন্যদিকে ভুলভাবে চালু করলে বড় ধরনের ক্ষতির ঝুঁকিও আছে। তাই প্রথমেই দরকার পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করা।

প্রথম ধাপে সরকার চাইলে ছোট পরিসরে একটি ‘রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স’ চালু করতে পারে। এখানে শুধুমাত্র যেসব মানুষ বা প্রতিষ্ঠান পরিচয় যাচাই করা (কেওয়াইসি-সম্মত) উৎস থেকে টাকা আনছে, তাদের খুব সীমিত পরিমাণে লেনদেনের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এই ধাপে মূলত সীমান্তপারের ছোট ছোট পেমেন্ট বা রেমিট্যান্স নিষ্পত্তির মতো স্বল্প ঝুঁকির কাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখা যেতে পারে। এতে বড় ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে না, কিন্তু বাস্তবে প্রযুক্তিটি কতটা কার্যকর তা বোঝা যাবে। এইভাবে ছোট পরিসরে পরীক্ষামূলক চালু করাকেই বলা হয় রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স। এর মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে প্রযুক্তিটা বাস্তবে কাজ করে কিনা তা বোঝা যায়। তারপর ধীরে ধীরে বড় পরিসরে চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

যদি এই পরীক্ষামূলক ধাপ সফল হয়, তখন দ্বিতীয় ধাপে যেতে হবে। এই ধাপে সরকার লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক্সচেঞ্জ ও কাস্টডিয়ান (যারা ডিজিটাল মুদ্রা নিরাপদে রাখে) গড়ে তুলতে পারে। এতে ক্রিপ্টো কেনাবেচা বা সংরক্ষণের সব কাজ নিয়মের আওতায় আসবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীর যোগ্যতা যাচাই করতে হবে, ঝুঁকি অনুযায়ী লেনদেনের সীমা ঠিক করতে হবে এবং পুরো খাতে স্পষ্ট করনীতি চালু করতে হবে। এতে কার কত লাভ হচ্ছে, কত কর দিতে হবে—এসব স্বচ্ছভাবে বোঝা যাবে।

এর পাশাপাশি শুধু ব্যবহার নয়, এই প্রযুক্তি নিয়ে দেশের ভেতর মানবসম্পদও তৈরি করতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ শুরু করা দরকার। আবার সাধারণ মানুষ যেন ভুল তথ্য বা প্রতারণার শিকার না হয় সেজন্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা প্রচার করাও খুব জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয়, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে নিজেরাই একটা ডিজিটাল মুদ্রা (CBDC) চালু করার ছোট প্রকল্প (পাইলট) শুরু করতে পারে। শুরুতে এটি সরকারি ভাতা বিতরণ বা ব্যাংকের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তির মতো সহজ ও নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। পরে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের খুচরা লেনদেনেও তা চালু করা সম্ভব হবে। এতে মানুষ ধীরে ধীরে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার শিখে যাবে এবং সরকারের পক্ষেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

 

সুযোগ কিন্তু শর্তসাপেক্ষ

এমন কাঠামো গড়ে উঠলে তখন আমরা ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তিকে জল্পনার বাজার নয় বরং ডিজিটাল অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অবকাঠামো হিসেবে দেখতে পারবো। এতে সবচেয়ে আগে উপকার পাবে সেসব তরুণ ফ্রিল্যান্সার, ক্ষুদ্র সফটওয়্যার ও গেমিং রফতানিকারক এবং ছোট অনলাইন ব্যবসায়ীরা, যাদের ক্ষুদ্র বৈদেশিক পেমেন্ট বারবার আটকে যায় বা দেরি হয়। যখন এই ভিত্তি গড়ে উঠবে তখন পরবর্তী ধাপে ফিনটেক ও স্টার্টআপ খাতে জন্ম নিতে পারে নতুন আর্থিক সেবা ও পণ্য, যেমন টোকেনাইজড ইনভয়েস ডিসকাউন্টিং বা সীমান্তপারের ক্ষুদ্র সাপ্লাই-চেইন ফাইন্যান্স। কিন্তু মোদ্দা কথা এই যে সঠিক নিয়ম-কানুন আর তদারকি ছাড়া আমরা এই বিশাল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবো না। বরং তখন সুযোগের বদলে অপচয়ই ঘটবে।

শেষ কথা এই যে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে। তা মেনে চলাই সবার দায়িত্ব। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রযুক্তির বিকাশ থেমে থাকে না। বরং নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে তা গোপনে বেড়ে ওঠে এবং তখন ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তাই ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারকরা যদি এই প্রযুক্তিকে বিবেচনায় আনতে চান, তাহলে তা সরাসরি চালু করা ঠিক হবে না। আগে সঠিক নিয়ম-কানুন গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে এবং নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রশ্নটা এখনই ‘চালু করা হবে কিনা’ নয়। বরং প্রশ্নটা হলো—ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে কীভাবে, কোন সীমায় এবং কবে তা করা যেতে পারে। এই ভাবনাটাই এখন নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

[এই লেখাটি বাংলা ট্রিবিউন থেকে নেয়া।]

 

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

Read more — মতামত
← Home